বাংলাদেশ ও মায়ানমারে মোঙ্গোলীয় মহাজাতির অন্তর্গত একটি জাতিসত্তার নাম তঞ্চঙ্গ্যা। চীন বা তিব্বত থেকে এরা আরাকানে বসতি স্থাপন করেছিল। এরাও নিজেদেরকে চীনা বংশোদ্ভূত বলে মনে করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মগ সম্প্রদায় এদেরকে 'দৈংনাক' নামে অভিহিত করে থাকেন। কারণ আরাকান প্রদেশের দৈংনাকপাড়া নামক স্থানে এরা এককালে বসবাস করত। এবং বাসস্থানের নাম অনুসারে তাদেরকে দৈংনাক বলা হয়। এরা আরাকানের স্থানীয় মগদের দ্বারা লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ভোগ করেই জীবনযাপন করতো। ১৪১৮-১৯ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানের শাসনকর্তা জালালুদ্দিনের অনুমতি ক্রমে তাঁরা বান্দরবনে বসতি স্থাপন করে। বর্তমানে আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর মদ্ধ্যে জনসংখ্যার দিক দিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের অবস্থান চতুর্থ।
উৎপত্তি
নৃ-ত্বাত্বিক ব্যাখ্যায় তঞ্চঙ্গ্যা মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর লোক। তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। তঞ্চঙ্গ্যাদের স্বভাব বেশ নম্র। তারা কিছু লাজুক স্বভাবেরও বটে।
আবাস
অন্যান্য পাহাড়ি জাতির মতো তনচংগ্যাদের আবাসভূমি গড়ে ওঠে পাহাড়ের অরণ্য অঞ্চলে। পার্বত্য চটগ্রামের রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায়, চটগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া থানার রইস্যাবিলি এলাকায় কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফে তনচংগা জনজাতির বসবাস। এছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম রাজ্যের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলেও তনচংগাদের আবাসভূমি রয়েছে। মায়ানমারের আরাকান এবং ছিন রাজ্যের এবং ইয়াংগুন শহরেও তনচংগ্যা রয়েছে। সেখানে তারা ‘দোইনাক’ নামে পরিচিত।
পেশা
তঞ্চঙ্গ্যা পেশা মূলত কৃষি। বিভিন্ন পাহাড়ে, টিলায় বা উঁচু ভূমিতে প্রস্তুত করা বাগান-বাগিচা বৃক্ষ রোপণ করেও কেউ কেউ জীবিকা নির্বাহ করে। অতীতে তারাও ব্যাপকভাবে জুম চাষ করতো যা র্বতমানেও অব্যাহত, তবে তুলনামূলকভাবে অনেকটা কম। তনচংগাদের মধ্যে শিক্ষিতের হার খুব বেশি নয়। তবে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেকেই চাকরি করে।
সংস্কৃতি
তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব পোশাক রয়েছে। তনচংগা নারী তাদের নিজস্ব পোশাকে দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। পাহাড়ি নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকার পরিধান করে তনচংগা নারী। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদে বৈচিত্র্যও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তনচংগা রমণীর পরনে থাকে প্রথমত সাত রঙের পিনুইন বা পিনন। পিননের দুই প্রান্তে লম্বালম্বি স্ট্রাইপ, মাঝখানে দুই প্রান্তে রঙের লম্বালম্বি স্ট্রাইপ এবং সমগ্র পিননে বিভিন্ন রঙের সুতার স্ট্রাইপ থাকে। তনচংগা রমণীরা অতীতে নানা ধরনের অলংকার পরত। তাদের ব্যবহৃত অলংকারের মধ্যে কানে রাজ্জু ও ঝংকা, কবজিতে বাঘোর, কুচিখারু, বাহুতে তাজজুর, গলায় চন্দ্রহার, হাচুলি, সিকছড়া প্রভৃতি উল্লেখযগ্য। এসব অলংকার সাধারণত রুপা দিয়ে তৈরি।
বিবাহ
তঞ্চঙ্গ্যাদের ভিতরে বিবাহ প্রথায় বৈধ-অবৈধ মান্য করা হয়। তঞ্চঙ্গ্যা পুরুষদের কাছে যে সকল নারী নিষিদ্ধ, তারা হলো সহদরা, সৎবোন (পিতা ভিন্ন মাতা এক বা মাতা ভিন্ন পিতা এক), আপন মা, সৎমা, খালা, ফুফু, ভাগ্নি, ভাইঝি, মামি, চাচি, সহোদর ভাইয়ের স্ত্রীর বোন, স্ত্রীর বড় বোন, শাশুড়ি, স্ত্রীর জ্ঞাতি (মামি, চাচি, খালা, ফুফু, ভাইঝি ইত্যাদি)। এই জাতীয় কোনো বিবাহ হলে, তাকে বলা হয় 'গরবা করুম'।




No comments:
Post a Comment